ঢাকা মেডিকেলে একদিন

উসমান বিন আবদুল আলিম
পড়তে লাগবে 4 মিনিট
সংগ্রহ

ফজরের পরপরই আসছি ঢাকা মেডিকেল। কাছের এক আত্মীয় অসুস্থ। আজ অপারেশন হওয়ার কথা। কিন্তু রুগীর আত্মীয়-স্বজন এখনো জানে না, অপারেশন কি আজকেই হবে ! গতকাল ডাক্তার কিছুই বলে যায়নি। অথচ তাঁদের কথামতো সবকিছু প্রস্তুত (পরীক্ষা,রক্ত ইত্যাদি)। অপারেশন আজকে না করতে পারলে আরো এক সাপ্তাহ এই হসপিটালের বেডে রুগীকে শুয়ে থাকতে হবে‌। এদিকে পায়ের সেই সমস্যা বেড়েই চলেছে। (এখন সকাল দশটা। অবশেষে ডিউটি ডাক্তার আসলো। ফাইল দেখলো। কথা হলো। ফাইল জমা নিলো। অপারেশন হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত জানাবে। হলে, কি কি লাগবে তাও জানাবে।) তারপরও আল্লাহর উপর ভরসা করে সবাই দু’আ করছে‌ । আল্লাহ তাআলা যেন সবকিছু আসান করে দেয় ও দ্রুত পরিপূর্ণ সুস্থ করে দেয়। আপনাদের কাছেও দু’আ চাই ‌।

যাক, যেটা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো; হসপিটালে এসে দেখি রুগীর কাছে কোন কাজ নেই। ডাক্তার আসলে কাজ আছে‌ । সময় এখনো প্রায় দুই ঘণ্টা। তাই ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগের সামনে এসে বসলাম। দীর্ঘক্ষণ বসে সবকিছু অবলোকন করছিলাম আর ভাবছিলাম।

জরুরী বিভাগের সামনে এম্বুলেন্সের বড় লাইন। সুযোগ বুঝে সাধ্যের বাইরে ভাড়া আদায় করা যাদের কাজ। তাঁদের কাছে মৃত-অমৃত নেই‌ ।

এই গেইট দিয়ে যারা প্রবেশ করে তাঁরা একরাশ হতাশা আর দুশ্চিন্তা/ ভয় নিয়ে প্রবেশ করে‌‌। আর যারা বের হয় : তাঁদের ভেতর দুই ধরণের মানুষ থাকে‌‌। এক, দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে স্বস্তির ঢেকুর নিয়ে মুখে হাসির ঝিলিক টেনে বের হয়‌ ।
দ্বিতীয়: যারা স্বজন হারানোর ব্যাথায়, বুকফাটা কান্না করে বের হয়‌। যাদেরকে বুঝ দেওয়ার মতো ভাষা অন্য কারো কাছে থাকে না।‌ প্রকৃতিও যেন তখন নীরব হয়ে যায়।

আমি জরুরী বিভাগের সামনে এক কোণেতে বসে বসে লেখছি। হঠাৎ কানে ভেসে আসলো,এক পরিবারের স্বজন বিয়োগের চিৎকার। একটি এম্বুলেন্সকে ঘিরে তাঁদের আহাজারি। কাছে গেলাম। চুপচাপ কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম। অতঃপর আধা ঘণ্টা পর এম্বুলেন্স পরিবারের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। তাঁদের একজন দেখলাম রাস্তার কিনারে বসে পড়লো। কাছে গেলাম। বসলাম। কথোপকথন শুরু করলাম।

_ হয়েছে কি ভাই?

তিনি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো ‘ আরে ভাই কি বলবো। দেশের অবস্থা ভয়াবহ। মানুষ এতো খারাপ। হসপিটাল গুলোর অবস্থা…’

_কেন?

তিনি উত্তর দিলেন ‘এম্বুলেন্সে যেই লাশ দেখছেন,সেটা বন্ধুর বৌ। প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঢাকার একটা ক্লিনিকে ভর্তি করেছিলাম। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ বললো,সিজার করা লাগবে‌ । প্রথমে বন্ধু রাজি না হলেও ডাক্তারের কথার ধরণ শোনে রাজি হলো । অনেকগুলো টাকা দিতে হলো। কিন্তু ডাক্তাররা অপারেশন করার সময়ই বন্ধুর বৌকে মেরে ফেললো।

_ ইন্নালিল্লাহ! কীভাবে?

তিনি জানালেন’ মূর্খ ডাক্তাররা অপারেশন করার সময় বন্ধুর বৌয়ের ‘জরায়ু’ কেটে ফেলে। তারপর অনর্গল রক্ত বের হতে দেখে তারা আমাদের রক্ত ব্যবস্থা করতে বলে। আমরা একে-একে বারো ব্যাগ রক্ত ব্যবস্থা করি। তারপর তাঁরা জানায় রুগী নিয়ে আমরা যেন আর্জেন্ট ঢাকা মেডিকেল চলে যাই। তখন কোনোকিছু না ভেবেই আমরা মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল আসি‌। এম্বুলেন্সের ভাড়া দিতে হয় ডাবল।

_আমি দেখছি তিনার শরীর কাঁপছে। সাহস দিলাম।

অতঃপর তিনি আবার বলতে লাগলেন ‘এখানে আনার পর তাঁরা আইসিইউতে রাখে। আরো রক্ত ব্যবস্থা করে দিলো। কিন্তু তারপরও বন্ধুর বৌকে বাঁচাতে পারলাম না। অধিক রক্তপাতে বন্ধুর বৌ আল্লার ডাকে চলে যায়‌‌। বাচ্চাটার বয়স একদিনও হয়নি। আমার বৌ বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে। এই বয়সে বাচ্চাটা মা হারালো। বন্ধু আমার কীভাবে নিজেকে বুঝ দেবে। এই বাচ্চা কে লালন-পালন করবে। আমারও একটা কোলের বাচ্চা আছে। ভাই শরীর কাঁপছে। আর কিছু বলতে পারি না।

_আমি বুঝালাম। অতঃপর বিদায় নিলাম। দেশের হসপিটাল গুলোর অব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবলাম। (ভালো ডাক্তার হলে, অবশ্যই খুব সতর্ক থাকতো। যদিও এটা আল্লাহর ফায়সালা। কখনো দেখা যায় রোগীর অবস্থা স্বাভাবিক থাকলেও হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সিজার করার জন্য দিশেহারা হয়ে যায় । এতে তাদের অনেক টাকা ইনকাম হয়) আফসোস করলাম। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলাম।

♥ঢাকা মেডিকেল জরুরী বিভাগের সামনে থেকে
✍ উসমান বিন আব্দুল আলীম
২১-৭-২০২২খৃ. , বৃহস্পতিবার

শেয়ার করুন
উসমান বিন আবদুল আলিম একজন উদীয়মান ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক। তরুণ বয়সেই তিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানার্জন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। কুরআন, হাদীস, ইসলামি দর্শন ও ইতিহাসের ওপর তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং চিন্তাশীল লেখনিতে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইসলামি মূল্যবোধ ও আধুনিক চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি একটি সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করছেন, যা বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে সহায়তা করে। পাশাপাশি, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখালেখি করছেন — যেখানে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, আত্মউন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের বিষয়ে তার বিশ্লেষণ প্রশংসিত হচ্ছে।
মন্তব্য নেই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।