শিক্ষার্থীদের জীবনে সময়ের গুরুত্ব

সময় আল্লাহ তাআলার দেওয়া অজস্র নেয়ামতের মধ্য থেকে অনেক বড় এক নেয়ামত। মহামূল্যবান এক সম্পদ। সময় মানেই জীবন; জীবন মানেই খণ্ড খণ্ড কিছু সময়ের সমষ্টি-রূপ। সময় কখনো কারও জন্য অপেক্ষা করে না।

বিন ইয়ামিন সানিম
পড়তে লাগবে 10 মিনিট

সময় আল্লাহ তাআলার দেওয়া অজস্র নেয়ামতের মধ্য থেকে অনেক বড় এক নেয়ামত। মহামূল্যবান এক সম্পদ। সময় মানেই জীবন; জীবন মানেই খণ্ড খণ্ড কিছু সময়ের সমষ্টি-রূপ। সময় কখনো কারও জন্য অপেক্ষা করে না। ঘড়ির কাঁটা কখনো থেমে থাকে না। প্রবহমান নদীর মতো নিজ গতিতে অনবরত বয়ে চলে। চলতেই থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত বিদ্যুৎচমকের মতো, এ-ই আকাশে জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়; হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।

সময় থেকে শুধু তারাই উপকৃত হতে পারে, যারা সময়ানুবর্তী, সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করেন, গুরুত্ব দেন। পক্ষান্তরে যারা অনর্থক ও বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে, সময় তাদের দূরে ছুঁড়ে দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে তাদের না-পাওয়ার ফিরিস্তি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, আফসোস ও অনুশোচনা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব : মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে সময়ের শপথ করেছেন। অনর্থক সময় ব্যয় করতে নিষেধ করেছেন। এগুলো সময়ের গুরুত্বের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে। ইসলামের অধিকাংশ বুনিয়াদি আমল সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি আমল নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হয়৷ এতেও সময়ের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, কোনো ব্যক্তির মধ্যে ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করা। (তিরমিজি : ২৩১৭)

কেয়ামতের দিন যে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া কেউ সামনে অগ্রসর হতে পারবে না, তন্মধ্যে প্রথম দুটি হচ্ছে সময় সম্পর্কিত—জীবন কোন কাজে ব্যয় করা হয়েছে, বিশেষ করে যৌবনকাল কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে, যখনই কোনো দিনের প্রভাত উদিত হয়, তখন সে মানুষকে সম্বোধন করে বলে, হে আদম সন্তান, আমি এক নতুন সৃষ্টি ও কর্মের সাক্ষী। সুতরাং আমার থেকে কিছু অর্জন করার হলে করে নাও। কেননা আমি কেয়ামত পর্যন্ত আর ফিরে আসব না। (কিমাতুয যামান ইনদাল ওলামা, পৃ. ১২৩)

শিক্ষার্থীদের জীবনে সময়ের গুরুত্ব :

শিক্ষার্থীরা হলো দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি অনেকটাই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তারাই আগামীর কর্ণধার। জাতির ঐতিহ্য নির্মাণে তারাই আশার আলো। তাই শিক্ষার্থীদের জীবনে সময়ে গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া জীবন গড়ার সবচেয়ে উত্তম সময় ছাত্রজীবন। এটি জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ছাত্রজীবনকে তুলনা করা হয় আগুনে পোড়ানো লোহার সাথে, পোড়ানো লোহাকে গরম থাকা অবস্থায় যেমন যেকোনো আকৃতি দেওয়া যায়, কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ইচ্ছামতো আকার দেওয়া যায় না। ঠিক ছাত্রজীবনও এমন একটা সময়, যা নির্ধারণ করে দেবে ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে। যদি ছাত্রজীবনে সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি; নিজেকে অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে বিরত রাখতে পারি, তাহলে পরবর্তী জীবন হবে সফল ও সার্থক। কর্মময় জীবনের সফলতা নির্ভর করে ছাত্রজীবনের সময়ের কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়েছে তার ওপর। জীবনের বীজ বপন করতে হয় ছাত্রজীবনে, নিজেকে গড়তে হয় এই সময়টাতে, তবেই সুফল পাওয়া যায়। ছাত্রজীবনে যদি সময়কে অবহেলা করা হয়, পরবর্তী জীবনে শত অনুশোচনাও তা আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সময়ের প্রতি যারা উদাসীন, তারা শুধু পরীক্ষাতেই খারাপ রেজাল্ট করে তা-না, বাকি জীবনও তারা ঘোর অন্ধকারে কাটায়। কাজেই ছাত্রজীবনে সময়কে কাজে লাগাতে হবে, অন্যথায় সারাজীবন এর মাশুল দিয়ে শেষ করা যাবে না। যে সময় গত হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ এই জগতে আর সম্ভব না।

ভবিষ্যতের আশায় ধোঁকা খেয়ো না।

অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয়, আমাদের তালিবুল ইলম ভাইয়েরা সময়ের প্রতি একেবারেই উদাসীন। অলসতার চাদর গায়ে জড়িয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। তারা মনে করে এখনোতো আমরা ছাত্র। ছাত্রজীবন স্বাধীন জীবন। যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করব, তখন সবকিছু করব। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। ছাত্রজীবনে আমাদের কোনো বাড়তি ব্যস্ততা নেই। সম্পদ উপার্জনের চিন্তা নেই। সাংসারিক ঝামেলা নেই। কারও সাথে দোস্তি-দুশমনি নেই। কোনো সভা-সমিতিতে যোগ দেওয়ার ফিকির নেই। তারপরও যদি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়কে কাজে না-লাগাই, তাহলে আর কবে সময়ানুবর্তী হবো? বয়স যতই বাড়বে, দায়িত্ব ততই বাড়তে থাকবে। বিষয় ও ব্যক্তি সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, একসময় দায়িত্বের ভারে ন্যুব্জ হওয়ার উপক্রম হবো। এভাবেই সময় কমে যাবে, আর শক্তি হ্রাস পেতে থাকবে। তাই উচিত ছাত্রজীবনেই সময়ের সদ্‌ব্যবহার করা। অজ্ঞাত ভবিষ্যতের জন্য কোনো কাজ ফেলে না-রাখা। কারণ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কোনো না কোনো ব্যস্ততা, কাজে বা অপ্রত্যাশিত বিপদাপদে পূর্ণ হয়ে যায়।

পূর্বসূরিদের মাঝে সময়ের গুরুত্ব:

পৃথিবীতে যাঁরাই সময়ের গুরুত্ব দিয়েছেন, সফলতা তাঁদের পদচুম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। ইতিহাসে যাঁরাই বরেণ্য হয়েছেন, পরিশ্রম ও সাধনার পাশাপাশি সময়ের সদ্‌ব্যবহার-ই তাঁদের লক্ষ্যার্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের আকাবির আসলাফদের জীবনী পাঠ করলে বোঝা যায়, তাঁরা সময়ের প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। জীবনের সামান্য সময়ও তারা অনর্থক ব্যয় করতেন না। তারা এমন সময়গুলো দ্বারাও উপকৃত হয়েছেন, যেগুলো অন্যরা এমনিতেই ব্যয় করে থাকে। তাঁদের প্রধান ও মূল ব্যস্ততা ছিল পড়ালেখা।

ইমাম আবু ইউসুফ রহ. যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত, তখনো তিনি ফিকহি একটি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন।হযরত দাউদ তায়ি রহ. রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রুটির পরিবর্তে ছাতু খেলে ৫০ আয়াত বেশি তেলাওয়াত করা যায়। (সফহাতুম মিন সাবরিল ওলামা।) আল্লামা আবু জাফর মাহরি রহ. সম্পর্কে কাযি ইয়ায রহ. বলেছেন, খুব কমই এমন হতো যে, খানা খাওয়ার সময় তাঁর হাতে কিতাব থাকত না। মুহাদ্দিস আবু নু’আইম আস্ফাহানি রহ. যখন রাস্তায় চলতেন, তখনও তাঁর নিকট কিতাব পড়া হতো। খতীব বাগদাদি রহ. রাস্তায় চলার সময় কিতাব অধ্যয়ন করতেন। ইমাম শামসুদ্দিন ইস্পাহানি রহ. কম আহার করতেন, যেন পানি পান করার প্রয়োজন না হয়, অন্যথায় শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন হবে, তাতে সময় নষ্ট হবে।

ইমাম ইবনুল জাওযি রহ. লিখেছেন, সময় যেন অনর্থক ব্যয় না হয়, তাই আমার সঙ্গে মানুষের সাক্ষাতের সময়ে আমি এমন কিছু কাজ করি, যেগুলো কথা বলার মধ্যেও করা যায়। আমি তখন কাগজ কাটি। কলম ধারাই ও খাতা বাঁধি। কারণ এই কাজগুলো করার জন্য খুব চিন্তা-ফিকিরের প্রয়োজন হয় না। আবার কাজগুলোও প্রয়োজনীয়। (শিক্ষার্থীদের সফলতার রাজপথ, পৃ. ১৭৫)

মোটকথা আমাদের পূর্বসূরিরা সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন বলেই ইলমে-আমলে সফল ও কামিয়াব হয়েছেন।

সময় সংরক্ষণ করব যেভাবে :

আমাদের পূর্বসূরিদের সামান্য এই আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, তাঁরা সর্বদা সময় দ্বারা সর্বোচ্চ উপকৃত হতে সচেষ্ট থাকতেন। আমরা এ-ও অনুধাবন করলাম, জীবনে বড় কিছু হতে হলে অবশ্যই সময়ের সদ্‌ব্যবহার করতে হবে। অতএব, সকলেই প্রতিজ্ঞা করি, আজ থেকে আমরা সামান্য সময়ও অনর্থক নষ্ট করব না। প্রতিটি মুহূর্তকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে কাজে লাগাব। এখানে সময় সংরক্ষণে সহায়ক কিছু দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।

এক. প্রতিটি কাজ সুশৃঙ্খলভাবে ও রুটিনমাফিক সম্পন্ন করা। দুই. অর্থহীন ও অনুপকারী মজলিসসমূহ থেকে বিরত থাকা। তিন. যেকোনো ক্ষেত্রে অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় পরিহার করা। চার. বিচক্ষণ, মেধাবী, সময়ের ব্যাপারে সজাগ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা। পাঁচ. বিশিষ্ট মনীষীদের উদ্দীপক ও প্রেরণাসৃষ্টিকারী ঘটনাবলী অধ্যয়ন করা। ছয়. সময় বের করে ও বাঁচিয়ে ইলমী কাজ সম্পাদন করার মিষ্টতার স্বাদ গ্রহণ করা৷ সাত. জ্ঞানের সমৃদ্ধি ও জানার পরিধি সম্প্রসারণে এবং বিভিন্ন বিষয়ে পঠন ও অধ্যয়নে যথাসম্ভব নিমগ্ন থাকা। আট. প্রত্যেক কাজে লৌকিকতা পরিহার করা। নয়. দ্রুত খাওয়া, দ্রুত হাঁটা, দ্রুত পড়া ও লেখা। দশ. নিজের প্রতিটি কাজ করা ও কথা বলার সময় লক্ষ রাখা, আমি কী করছি, ও কী বলছি। তারপর রাতে ঘুমানোর আগে সারাদিন কীভাবে কাটল তার মুহাসাবা করা। (শিক্ষার্থীদের সফলতার রাজপথ, পৃ. ১৮৩,)

আমাদের পূর্বসূরিরা সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতিদিন তাদের কথা ও কজের মুহাসাবা করতেন, সেগুলো খাতায় লিখে রাখতেন। ঘুমানোর আগে খাতায় নজর বুলাতেন। এবং যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন। কোনো কাজের কারণে ইস্তেগফার, কোনোটির কারণে তওবা আবার কোনোটির জন্য শোকর আদায় করতেন।

সময় বিনষ্টকারী বিষয়াদি :

এক. বন্ধু-বান্ধব মিলে আড্ডা দেওয়া, গল্প-গুজব করা। দুই. সময় বিনষ্টকারী সবচেয়ে বড় মাধ্যম মোবাইল-ফোন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে ডুব দিলে সময় অতিদ্রুত কোনদিক দিয়ে চলে যায় টেরই পাওয়া যায় না। তিন. খারাপ কোনো অভ্যাসে আসক্ত হয়ে যাওয়া। যেমন, ফ্লিম, নাটক-সিনেমা দেখা, গান-বাজনা শোনা, হারাম রিলেশনে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। চার. খেলাধুলা ও ঘুমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা। ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা। পাঁচ. একে অপরের দোষচর্চা করা, গীবত-শেকায়েত, সমালোচনা, ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি।

অতীতের সময়গুলো থেকে বর্তমানের সময়গুলো কেমন যেন ভিন্ন প্রকৃতির। খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধ। প্রযুক্তির পরিবর্তনের স্রোতে বদলে যাচ্ছে সবকিছু। মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটি হতে হবে সীমার মধ্যে। অথচ চারদিকে একটু চোখ বুলাতেই দেখা মেলে—সারাক্ষণ মোবাইলের স্কিনে বুঁদ হয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের। আবালবৃদ্ধবনিতা সবার একই অবস্থা। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার এখন মহামারির আকার ধারণ করেছে।

ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন, সময় হলো তরবারি; যদি তুমি তাকে না কাট, সে তোমাকে কেটে ফেলবে। তিনি আরও বলেন, তুমি যদি নিজেকে সত্য ও ন্যায় কর্মে ব্যস্ত না রাখ, তাহলে সে তোমাকে অসৎ ও অন্যায় কাজে লিপ্ত করবে। (কিমাতুয যামান ইনদাল ওলামা)। একটি প্রবাদ বাক্যও আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের ঘর। তাই অলস বসে থাকা যাবে না। সময়ের সদ্‌ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তেকে কাজে লাগাতে হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবধরনের সময় বিনষ্টকারী বিষয়াবলি থেকে হেফাজত করুন। এবং সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন করে জীবনকে গড়ার ও নিজেকে সমৃদ্ধ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক নবীনকণ্ঠ

শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।