ভ্রমণ মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্যময় জানার জন্যও ভ্রমণের বিকল্প নেই। বিশ্ব-বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছেন, ‘ভ্রমণ স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য জানায়, ভ্রমণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়’।
ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধি পায়। অর্জিত হয় কিছু জানাশোনা আর কিছু অভিজ্ঞতা। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে ভ্রমণ সবসময়ই আনন্দময় ও তৃপ্তিদায়ক হয়ে থাকে। তবে ভ্রমণটি গুনাহমুক্ত, আল্লাহর নিদর্শন দেখা ও জ্ঞান অন্বেষণ করার জন্য হতে হবে। তখনই ভ্রমণ সার্থক হবে।
ভ্রমণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক স্থানে গিয়ে বিভিন্ন বিষয় জানা যায়। পূর্বেকার ব্যক্তিদের দেখে শিক্ষা অর্জন করা যায়।
পৃথিবীতে বিচরণ করলে বুঝা যায় আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য। কারিগরহীন কতো নিপুণভাবে তিনি এই পৃথিবীকে ও পৃথিবীর সকল প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন।
ভ্রমণ করার মাধ্যমে জানা যায় পূর্বেকার জালেম বা মিথ্যাবাদীদেরকে আল্লাহর দেওয়া শাস্তির বর্ণনা। তাদের থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়,- নিজেকে শোধরাবার পন্থা বের করা যায়।
ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো, অতঃপর দেখো, যারা সত্যকে মিথ্যা বলেছে, তাদের পরিণাম কী হয়েছিল?’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১১)
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলেন;
বলো, ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো, কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন? অতঃপর আল্লাহ সৃজন করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা-২৯ আনকাবুত, আয়াত: ২০)।
তাই মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সাথে ছুটে যাই দেশের এ-প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ঘুরে বেড়াই বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। ইচ্ছে আছে পুরো পৃথিবীকে নিজ চোখে দেখার, আল্লাহর সৃষ্টি সমূহকে অবলোকন করার, ইন শা আল্লাহ।
সেদিন বন্ধুবর হুসাইনের নিমন্ত্রণে রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলায় যাওয়ার সুযোগ হয়। তাদের বাড়ি বাঘা থানার চকরাজাপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাঘা উপজেলায় এসে অটোরিকশায় চড়ে সোজা দাদপুর গ্রাম। অবশ্য রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে প্রচুর পরিমাণ ঝাঁকুনি খেতে হয়, যা সফরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। অল্পতেই শরীর দুর্বল করে ফেলে। যদিও আমরা দেখি গ্রামে-গ্রামে বর্তমান সরকারের উন্নতি। কিন্তু সেই জায়গার রাস্তার এই করুণ অবস্থা এমন কেন জানতে চাইলে স্থানীয়রা বিবরণ করেন্র, যা শুনে আমি হতভম্ব। জানি না এই ব্যবধান কেন? তারাও তো দেশের নাগরিক! যাক অবশেষে তার বাড়িতে পৌঁছাই। তাঁর মায়ের হাতের হরেকরকম তরকারি দিয়ে দুপুরের ভোজন শেষ করি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে (আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি অভ্যাস ছিলোপ্রতিদিন দুপুরের আহারের পর কিছু সময় ‘কাই লু ল্লাহ’ করার)
বেরিয়ে যাই। গ্রামটি ঘুরে দেখি। গ্রামটির বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটি প্রবন্ধ হয়ে যাবে। বলতে চাইলে বলবো_অসাধারণ একটি গ্রাম। সবুজ-শ্যামল এই ছোট্ট গ্রামটিতে প্রায় পনেরো হাজার মানুষের বসবাস। দু’পাশে সারিবদ্ধ তাল গাছ। এঁকেবেঁকে রাস্তা। মাঝেমধ্যে বিশালাকার ফসলি-যমিন। কিছুদূর পরপরই মানুষের বসবাস।একটি বড় বাজার। কয়েকটি প্রাইমারি স্কুল। তিন-চারটি মসজিদ। পুরো গ্রাম জুড়ে একটিমাত্র মাদ্রাসা, তাও আবার সেই মাদ্রাসাটি বন্ধ। বিষয়টি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম।
আমরা এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে এক পর্যায়ে পদ্মার পার চলে যাই। ততক্ষণে পদ্মার ওপাশে দিনমনি পশ্চিমাকাশে রক্তিম লালিমা ছড়িয়ে বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। একদিন আমাদেরকেও এই বসুন্ধরা থেকে বিদায় নিতে হবে, চিরস্থায়ী বিদায়। প্রস্তুতি আছে কি আমাদের? অনুশোচনার বিষয়।
মাগরিবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু চারিপাশ থেকে কোনো আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে না। মসজিদের খোঁজে বের হলাম। কিছুদূর যেতেই মসজিদের দেখা মিলে। হাতে গোনা কয়েকজন মুসুল্লির দেখা পেলাম। একজন মুখ দিয়ে আজান দিলো। আমরা তড়িঘড়ি করে ওযু করে মসজিদে প্রবেশ করি। আমাদের দিকে মুসুল্লিদের চাহনি দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যাই।পরক্ষণেই বুঝতে পেরেছি এলাকাটিতে সাধারণত হুজুরের দেখা মেলে না। হঠাৎ জুব্বা পরিহিত দু’জন হুজুর কোথার থেকে আসলো (!) তাই তারা অপার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মুসুল্লিদের সাথে পরিচয় হলাম। তারা বললো হুজুর, আমাদের ইমাম নেই আপনাকেই নামাজ পড়াতে হবে। আমি কৌতূহল হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেন? তারা জানালেন, হুজুর আমাদের মসজিদের শুধু জুমার নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম রয়েছে, তাও তিনি অনেকদূর থেকে আসেন। কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমাম নেই। আমাদের এলাকায় এরকম হুজুর নেই যে, যিনি এখানে ইমামতি করবেন। তাই আমরা নামাজের সময় হলে মসজিদে এসে আজান দিয়ে থাকি। কেউ নামাজ পড়ানোর থাকলে তিনি পড়ান অন্যথায় আমরা যে যার মতো করে নামাজ আদায় করে বাড়িতে চলে যাই। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে নামাজ পড়ালাম। ভাবলাম এমনও এলাকা আমাদের বাংলাদেশে রয়েছে! নিজেদের জন্য আফসোস হলো। আমরা দ্বীনি কাজ কতটুকু করছি? কী জবাব দিবো প্রভুর দরবারে?
নামাজ পড়ে মুসুল্লিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। পথিমধ্যে কিছু লোককে দেখতে পেলাম, যারা আমাদেরকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, আপনারা কি আমাদের এলাকায় তাবলীগে আসছেন। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম তাদের এরকম প্রশ্নের কারণ। সে উত্তর দিলো, আমাদের এলাকায় সাধারণত হুজুর দেখা যায় না।পুরো গ্রামে শুধু আমি একাই আলেম। আরো কয়েকজন আছে কিন্তু তারা শুধু নিজের নামাজ পড়তে বা মাঝেমধ্যে পড়ানোর ভেতরই সীমাবদ্ধ।
পরদিন সকালে নাস্তার পর্ব শেষ করে আবার বের হলাম। এলাকার একটি বড় আম বাগানে গিয়ে বসি। আমাদের দেখে সেখানকার আশপাশ থেকে কিছু ছেলে-মেয়ে ছুটে আসে। আমি তাদের সাথে পরিচয় হই। বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করি। একপর্যায়ে আমি তাদেরকে ‘কালেমায়ে-তাওহীদ’, নামাজের কথা, কালেমায়ে ‘শাহাদাত’, সূরা ফাতেহা ও টুকটাক কিছু ইসলামি বিষয় জিজ্ঞেস করি। যা সাধারণত বাচ্চাদের জানা থাকার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা কেউ আমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা বাসায় বা সকালে মক্তবে আরিবী পড়ো না? তাদের উত্তর ছিলো, আমাদের বাসায় তো পড়ায়নি, কিন্তু একটি মক্তব ছিলো, তাও কয়েকবছর আগে। এখন আর সেটা নেই, তাই আমরাও পড়ি না। একটা দশ বছরের বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলামতুমি কি মসজিদে যাও নামাজের জন্য? সে বললো; আমি তো সূরাই পারি না, নামাজ কীভাবে পড়বো! আমি বন্ধুবর হুসাইনকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেন? এই বয়সের বাচ্চারা তো এগুলো শিখে থাকে। একটা দশ বছরের বাচ্চা তো মসজিদে যাওয়া-আসার অভ্যাস করে। কিন্তু এরা তো কিছুই জানে না। এদের কোন ইসলামি জ্ঞান নেই! বাচ্চারা কালেমা জানে না!
সে তখন বললো; একসময় আমাদের গ্রামে একটা মক্তব ও মাদ্রাসা ছিলো। যেখানে আমরা শৈশবে পড়াশোনা করেছি। এমনকি কৈশোরও আমরা এখানে পার করেছি। কিন্তু এলাকা থেকে যাওয়ার পর কোনো ভালো আলেম না থাকায় বা পরিচালনার জন্য যোগ্য লোক নেই বিধায় মাদ্রাসাটি চার-পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। আর খোলা হয়নি। তবে আমি চেষ্টা করছি। অর্থের প্রয়োজন। মাদ্রাসার মেরামত করতে হবে। শিক্ষকদের বেতনের জন্য ভাবতে হবে। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে বিদ্যুৎ অফিস করা হয়েছে। তাদেরকে টাকা দিয়ে সরাতে হবে’।
বন্ধুটি মলিন চেহারা নিয়ে কথা গুলো বলে যাচ্ছে। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, হাফিজ্জি হুজুর রহ. কেন বলেছিলো_প্রতিটি গ্রামে একটি করে মক্তব গড়ে তুলতে হবে। এই কথার মর্ম আজ অনুধাবন হচ্ছে, কেন হুজুর রহ. কথাটা বলেছিলেন। আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছি। আল্লাহ তায়া’লা হুজুরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের আ’লা মাকাম দান করুক, আমীন।
আমরা এখন যা বুঝতে পারি, প্রতিটি গ্রামে একটি করে মক্তব করা জরুরী। বাচ্চাদের ইসলামিক শিক্ষা দিতে হবে। তাদের পেছনে মেহনত করতে হবে। আর এরজন্য প্রথমে পরিবারকে ইসলামের দিকে ধাবিত করতে হবে। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারা সাধ্যমতো নিজেদের এলাকায় ছোট ছোট মক্তব করে তুলতে হবে। অথবা যাদের জানা আছে তারা নিজেদের সময় অনুযায়ী তাদেরকে ডেকে এনে প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়া। আমরা যদি সোচ্চার না হই তাহলে দিনদিন এদেশ থেকে ইসলাম উঠে যাবে। উপরোক্ত এলাকার মতো প্রতিটি গ্রামের অবস্থা হয়ে যাবে।আমাদের দেশের অনেক দাওয়াতি সংগঠন আছে তারা কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সাথে সাথে আমাদেরও সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় পশ্চিমা সভ্যতার থাবায় এদেশ থেকে ইসলাম উঠে যেতে বেশিদিন লাগবে না। এ সমস্ত গ্রাম গুলোতে ইয়াহুদী-নাসারাদের থাবা বেশি। সহজেই তাদের ব্রেণ ওয়াশ করতে পারে। তাই যেখানে পুরনো মাদ্রাসা আছে সেই মাদ্রাসা গুলোর যত্ন নিতে হবে। মাদ্রাসা না থাকলে সবার প্রচেষ্টায় প্রতিটি গ্রামে একটি করে মাদ্রাসা গড়ে তুলতে হবে। এলাকার মানুষদের বুঝিয়ে মাদ্রাসার প্রতি মোহাব্বত বাড়াতে হবে। তাদের থেকে মাদ্রাসার জন্য সহোযোগিতা নিতে হবে।পাড়ায়-পাড়ায় মক্তব তৈরি করতে হবে।বাচ্চাদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য মক্তবের গুলোর বিকল্প নেই।
যতদিন এদেশে হক্কানি আলেম-উলামা থাকবে, মাদ্রাসা গুলো থাকবে, মক্তব থাকবে প্রতিটি এলাকায়। ইন শা আল্লাহ ততদিন এদেশে ইসলাম থাকবে।
আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও দ্বীনি কাজ বেশি বেশি করার তৌফিক দান করুক, আমীন।
লেখক, উসমান বিন আব্দুল আলিম
মোহাদ্দেস, জামি’আ ইসলামিয়া আরাবিয়া বলিয়ারপুর, সাভার, ঢাকা।