একটু আগে ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে। আজানের মিষ্টি সুরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে শাবীব। দুহাত দিয়ে চোখ মর্দন করে সে। অভ্যাসমত ঘুম থেকে জাগার দুআ পড়ে নেয়। আলহামদুলিল্লাহিল্লাযি আহইয়ানা …।
ড্রিমলাইটের ক্ষীণ আলোয় রুমজুড়ে আবছা আলো। চরিদিকে অন্ধকার বিরাজ করছে। গতরাতে আকাশে জোসনা ছিল। হৃদয়কাড়া সোনালী জোসনায় আকাশটা যেন নববধূর রূপে সেজেছিল। মায়াবী চাঁদের জোসনায় পৃথিবীটাকে দারুণ স্নিগ্ধ লাগছিল। আলোয় চারপাশটা যেন প্লাবিত হয়ে যাচ্ছিল। এই একটা চাঁদের আলোয়ই তো অনন্তকাল কাটিয়ে দেয়া যায় । আকাশের মালিক কত দৃষ্টিনন্দন করেই না একটি রুপালী চাঁদ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন। স্নিগ্ধ রুপসী কন্যার হৃদয়কাড়া রূপকেও হার মানায় যে মায়াবী চাঁদ । হাজার বছর চেয়ে থাকলেও যেন তার রূপসুধা শেষ হবে না। অনন্তকাল শুধু অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলেও যেন সাধ মিটবে না।
ফোনটা হাতে নেয় শাবীব। শ্রাবণের রাত। অনেক ছোট। ঘুমুতেই যেন কিভাবে রাতটা ফুরিয়ে যায়। সারারাত ওর ভালোই ঘুম হয়েছে। ঘুমটা ভাল হলে সারাটা দিন নিজেকে খুব নির্ভার লাগে। ফুরফুরে মেজাজে দিনটা কেটে যায়। সকল কাজে দারুণ পুলক অনুভব হয়।
ঘড়ির কাটা এখন চারটা পঞ্চাশ। ফজরের ওয়াক্ত হতে এখনো আধাঘন্টা। পাশেই নাহদিয়া ঘুমোচ্ছে। বড় নিষ্পাপ লাগছে ওর লাবণ্যময়ী চাঁদমুখখানি। মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মনে হয় সবচেয়ে ভালো লাগে। অস্থির কোলাহলময় পৃথিবী থেকে ক্ষণিকের জন্য একজন ঘুমন্ত মানুষ হারিয়ে যায় দূর অজানায়। হিংসা বিদ্বেষ আর কপটতার দুয়ার রুদ্ধ করে ভালোবাসার এক নতুন দিগন্তে হারিয়ে যায় সে।
মাসখানিক হতে চলল শাবীব নাহদিয়ার বিয়ে হয়েছে। দু পরিবারের সম্মতিতে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। শাবীব একজন আলেম। পেশায় একজন শিক্ষক। লেখালেখির বাতিক আছে। পাশাপাশি বক্তৃতাটাও উপভোগ করে সে। শাবীব মজা করে বলে- “শিক্ষকতা আমার পেশা। লেখালেখি আমার নেশা। বক্তৃতা আমার ভালোবাসা।”
নাহদিয়া দাওরায়ে হাদিস শেষ করেছে গত রমজানের আগে। হাইআতুল উলিয়ায় ভালো ফলাফলও করেছে। কৈশোরে পদার্পণেই কুরআনুল কারিম হিফজ করে নিয়েছিল সে। নাহদিয়ার তিলাওয়াত অসাধারণ। শুধু শুনতেই মন চায়। দারুণ আবেগ আর ভালোলাগা থাকে তিলাওয়াতের মাঝে। শাবীব বিয়ের জন্য নাহদিয়াকে দেখতে এসে তিলাওয়াত শুনেই মুগ্ধ হয়ে যায়। ওর প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে পড়ে। ভাবে, একটা জীবন তো ওর তিলাওয়াতের মাধুর্যতায় কাটিয়ে দেয়া যাবে অনায়াসে। তবুও তার মজা শেষ হবে না।
শাবীব নাহদিয়ার ঘুমন্ত চেহারায় তাকিয়ে আছে। কী এক স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর চেহারাজুড়ে। যেন দিনমান তাকিয়ে তাকলেও সাধ মিটবেনা। তবুও দেখতে মন চায়। একবার, দুবার, অনেক বার। নাহদিয়ার গোলাপী গালে কোমল হাতে স্পর্শ করে শাবীব। ভালবাসা জড়ানো চুম্বন উপহার দেয় সে। শাবীবের প্রেমময় স্পর্শে জেগে ওঠে নাহদিয়া। অসাধারণ সৌন্দর্যের আধার চোখদুটো খুলে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে ভালবাসার জবাব দেয় সে। রুমজুড়ে মিষ্টি আবেশ ছড়িয়ে। পৃথিবীতে হাসির চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নেই। চাঁদের সোনালী আলোও যেন হাসির সৌন্দর্যের কাছে ম্লান। মূল্যহীন।
ফ্রেশ হয়ে তারা দুজনে ফজরের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে নাহদিয়া শাবীবের জন্যে নুডলস আর চা নিয়ে আসে। নাহদিয়ার রান্নার হাত অসাধারণ। যা রান্না করে তাতেই যেন পৃথিবীর সব স্বাদ চলে আসে। নাহদিয়ার প্রত্যেকটি কাজই যেন ঈর্ষাজাগানিয়া। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শাবীব জানায়, একটু পরে সে বেরোবে। প্রিয়তমার উষ্ণ সান্নিধ্যের সুরভী মেখে ভোরের শিশির ভেজা দূর্বাঘাসে দুজনে মিলে হাঁটবে। আনমনে দুহাত ধরে হেঁটে হেঁটে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবে। প্রভাতবিলাসের এ পরিকল্পনা শুনে নাহদিয়ার চেহারায় খুশিরঝিলিক দেখা দেয়। টোলপড়া গালে হাসির রেখা ফুটিয়ে সে তার ভালোলাগার জানান দেয়। ভোরের আলো ফুটার আগেই শাবীব নাহদিয়া বেরিয়ে পড়ে।
বাসা থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে খানিকটা হেঁটে ডানদিকের গলিটায় ঢুকে পড়ে তারা। গলিটার শেষমাথায় “বালুর মাঠ”। গন্তব্য সেখানেই। শাবীবের ভায়রা মাওলানা বখতিয়ার সাহেবও বেরিয়েছেন সস্ত্রীক। শাবীবরা একটু আগেই বালুর মাঠে পৌঁছে যায়। চারদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজ নরম দুর্বাঘাসের কোমল স্পর্শে শরীরে শিহরণ জাগছে বারবার। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে সবুজের গালিচায় বসে পড়ে শাবীব নাহদিয়া। চারপাশটা নিরব নিস্তব্ধ। আকাশটাও বর্ণিল সাজে সেজেছে। ফোনটা বের করে বর্ণিল আকাশটার কয়েকটা ছবি তুলে নেয় শাবীব। কদিন ধরে আকাশটা দারুণ সুন্দর লাগছে। মেঘের আল্পনা আর সূর্যিমামার উকিঝুঁকি সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন আকাশটা প্রকৃতিকে দারুণ মায়াময় করে তুলছে।
শাবীব নাহদিয়া বসে আছে। ভালোবাসার গল্পে গল্পে সময়টা দারুণ কাটছে তাদের। একফাঁকে কয়েকটা সেলফী তুলে স্মৃতিময় মুহুর্তটাকে ধারণ করার চেষ্টা করে শাবীব। কিছুক্ষণের মধ্যেই বখতিয়ার সাহেব চলে আসেন। কোলে ছোট্ট বারীরা। নাহদিয়া তার বড় আপুর সাথে হাঁটতে থাকে। শাবীব বখতিয়ার সাহেবকে নিয়ে চারপাশটায় চক্কর দিতে থাকে। একজন প্রাণবন্ত খোশমেজাজের মানুষ বখতিয়ার সাহেব। আরো দুজন ভায়রা থাকলেও বখতিয়ার সাহেবের সাথেই দারুণ সখ্য শাবীবের। বখতিয়ার সাহেবও পরম মমতায় স্নেহের ডোরে বেঁধে নিয়েছে শাবীবকে। সহোদর ভাই না থাকার কষ্ট খানিকটা হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে সে বখতিয়ার সাহেবের মাধ্যমে। দারুণ বুঝাপড়া দুজনের মাঝে।
ধীরে ধীরে সূর্যিমামা তার আভা ছড়িয়ে চারপাশটা রাঙ্গিয়ে তুলছে। শিশিরভেজা দূর্বাঘাসগুলো সূর্যের আলোকচ্ছটায় চিকচিক করছে। প্রভাতবিলাসের এই মিষ্টিপ্রহর হৃদয়জুড়ে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে। ভালোলাগার এই প্রহরগুলো কেন দ্রুত কেটে যায় বুঝে আসে না শাবীবের। হায়! সময় যদি থমকে দাঁড়াত। ভালোবাসার এ মুহুর্তগুলো যদি আরো দীর্ঘ হতো।
এভাবেই ফজরের মিষ্টি আলোয় শুরু হয় শাবীব-নাহদিয়ার নতুন দিনের গল্প। ভালোবাসা, প্রশান্তি আর কৃতজ্ঞতার মায়াবী আবেশে ভরে ওঠে তাদের সকাল। প্রতিটি প্রহর যেন চাঁদের জোসনার মতোই স্নিগ্ধ আর অনন্ত। সত্যিই, ভালোবাসার এই জীবনই তো সবচেয়ে বড় জোসনা রাত – যেখানে দু’জন মানুষের মিলনেই সৃষ্টি হয় এক স্বপ্নীল পৃথিবী।
“সময় চলে যায়, কিন্তু ভালোবাসা রয়ে যায় হৃদয়ের আকাশে অনন্ত রুপালি জোছনা হয়ে।”
শিক্ষক, লেখক ও আলোচক