হাদিসের আলোকে পবিত্র ঈদুল ফিতর দিনে করণীয় ও বর্জনীয়

ওমর ফারুক হানজালা
পড়তে লাগবে 5 মিনিট

ঈদ আরবি শব্দ। ঈদ শব্দের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। তার মধ্যে একটি অর্থ হলো খুশী বা আনন্দ।আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন মুসলমানদেরকে বছরান্তে দু’টি দিবস ঈদ হিসেবে দান করেছেন।ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এ দু’টি দিবসই অত্যন্ত মর্যাদাশীল, আনন্দ ও খুশির দিন। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম উম্মাহর জন্য খুশির সওগাত নিয়ে আসে কাঙ্খিত ঈদ। ঈদ খুশির, ঈদ আনন্দের, ঈদ ক্ষমার, সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর দিনই হলো ঈদ।

শরিয়তে যেভাবে ঈদের প্রচলন শুরু হয়:
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বীয় বান্দাদেরকে বছরান্তে দু’টি ঈদ দান করেছেন।তা একমাত্র তাঁর নেয়ামতই বটে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা শরীফ হতে হিজরত করে যখন মদিনা শরীফ পৌঁছলেন, তখন মদিনাবাসীদেরকে নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে বছরান্তে দু’টি আনন্দ দিবস উদযাপন করতে দেখলেন, যে দিবসগুলোতে তারা শুধু খেলা-ধুলা, আমোদ-ফুর্তি করে। হযরত আনাস রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন এ দু’দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা জাহেলী যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদেরকে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টি দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।
(সুনান আবূ দাউদ : ১১৩৪)

ইসলামী দিক নির্দেশনা অনুযায়ী যদি আমরা ঈদ উদযাপন করি তবে একদিকে যেমন ঈদের অনাবিল আনন্দে ভরে উঠবে আমাদের পার্থিব জীবন,অন্যদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হবে আমাদের পরকালিন জিন্দেগী। পবিত্র দিবসে ইসলামী দিক নির্দেশনার প্রতি লক্ষ্য রেখে যে বিষয়গুলো আমাদের করণীয়:

১.ঈদের দিন গোসল করা :
ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। ইবনে উমর রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (সুনান বায়হাকী : ৫৯২০)

২.নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা :
ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।(আলজামেউস সহীহ : ১৮৮৭)

৩.পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া :
হযরত আলী রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : সুন্নাত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।(সুনান আত-তিরমিযী : ৫৩৩)

৪.যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ [সহীহ বুখারী : ৯৮৬]

৫.তাকবীর পাঠ করা :
তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ। বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। (মুসতাদরাক : ১১০৬)

৬.ঈদের নামায আদায় করা :
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের নামায আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ আদায় করেননি।(সহীহ বুখারি : ৯৮৯)

৭.ঈদ উপলক্ষে পরস্পরে শুভেচ্ছা বিনিময় করা:
মুসলমানগণ পরস্পরে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করাতে অসুবিধা নেই। কারণ সাহাবীগণ ঈদ উপলক্ষে তা করতেন। তারা এই বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكَ
”তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের এবং আপনার (ইবাদত-বন্দেগী) কবুল করুন।
(বায়হাকী (২/৩১৯)

৮.ফিতরা দেয়া :
রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে অভাবগ্রস্তদের ফিতরা প্রদান করা।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন।(সহীহ বুখারি : ১৫০৩)

ঈদ মুসলমান জাতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। মুসলমান হিসেবে আমাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে। সে সংস্কৃতি হতে হবে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস সমর্থিত । ঈদ পালনে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব বিনোদন বা সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হওয়া খুবই গর্হিত কাজ। মুসলমান হিসেবে আমাদের বর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।
অত্যান্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমরা দেখতে পাচ্ছি ঈদ উদযাপনের নামে বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। আবদুল্লাহ বিন আমর রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।(আবু দাউদ : ৪০৩৩)
ঈদ উৎসবের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা তার ধর্মীয় জীবনের এবং সমাজ জীবনের বহিঃপ্রকাশ, সাম্য মৈত্রীর সন্ধান লাভ করে। বিশ্ব মুসলমানের জীবনে রামাদ্বান যেমন আত্মশুদ্ধি ও সাম্যের বার্তা নিয়ে হাজির হয় ঠিক তেমনি ঈদ বয়ে আনে সাম্য-মৈত্রী-সম্প্রতির সুমহান বার্তা। ঈদ হোক আমাদের জীবনের নিত্যসাথী।

লেখক, ওমর ফারুক হানযালা
মুফতি ও মুহাদ্দিস

শেয়ার করুন
মন্তব্য নেই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।