ইসলামই নারীকে সম্মানজনক অধিকার দিয়েছে

মুফতী রহমতুল্লাহ জুবাইর

মুফতী রহমতুল্লাহ জুবাইর
পড়তে লাগবে 7 মিনিট

আল্লাহ তাআলা নারী জাতিকে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং মানবজাতির প্রজনন ক্ষেত্র বানিয়ে মাতৃত্বের সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন।
ইসলাম ও ইসলামী বিধি-বিধান নারীকে যে পরিমাণ সম্মান দান করেছে এ পরিমাণ সম্মান নারীকে অন্য কোন ধর্ম দান করেনি। ইসলাম পূর্ব জাহেলি যুগে আরবরা কন্যা সন্তান জন্মগ্ৰহণ করলে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিতো। সমাজে নারীদেরকে দাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তাদেরকে ভোগ্যপণ্যের মতো মনে করা হতো। শুধু তাই নয়, মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হতে নারীদেরকে মীরাসও দেয়া হতো না। আধুনিক যুগেও পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীদেরকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে এবং তাদেরকে বাজারের সদাই বানিয়ে রেখেছে।
পক্ষান্তরে ইসলাম নারীদের সগৌরবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। পর্দার আবরণে আবদ্ধ করে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনা থেকে নিষ্কৃতি দান করে সম্মানজনক পোশাক প্রদান করেছে এবং ভোগবাদী পুরুষরূপী নর পশুদের যাঁতাকল থেকে মুক্ত করে নারীদেরকে ঘরের চেরাগ বানিয়েছে। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে।

দ্বীনদার নারীর ফযিলত:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,স্মরণীয় সেদিন, যেদিন আপনি দেখবেন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদেরকে, তাদের সম্মুখ ভাগে ও ডান পাশে তাদের জ্যোতি (নূর) ছুটোছুটি করবে। তাদের বলা হবে- আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তাতে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা আল হাদীদ:১২)
উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কেয়ামতের দিন মহাসংকটের মুহূর্তেও শুধু পুরুষরাই নূরের অধিকারী হবে এমন নয়, বরং পূণ্যবতী নারীরাও সে নূরের অধিকারী হবে।
এমনিভাবে হাদীস শরীফে পূণ্যবতী নারীকে সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-এ বিশ্ব ভূমন্ডল পুরোটাই উপভোগ্য সামগ্রী। তন্মধ্যে সর্বোত্তম সামগ্রী হলো নেক ও পূণ্যময়ী নারী (স্ত্রী)। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ১৪৬৭)

নারীর উত্তরাধিকার:
ইসলাম ধর্মই সর্বপ্রথম নারীর উত্তরাধিকার আইন প্রবর্তন করে। ইসলামের আবির্ভাবের পর মানুষ জাহেলী যুগের সকল অন্যায় অবিচার শোষণ আর বঞ্চনা থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় নারী জাতির উত্তরাধিকারসহ মানবিক সকল অধিকার। উহুদ যুদ্ধের পর সাহাবী হযরত সাদ ইবনে রবী রাদি. এর স্ত্রী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা দুজন সাদ বিন রবীর কন্যা। সাদ উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আর তাদের চাচা তাদের সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। তাদের জন্য কোন কিছুই রাখেনি। অথচ সম্পদ ছাড়া তাদের বিবাহ সম্ভব নয়। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত করবেন। অতঃপর উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুই মেয়ের চাচাকে ডেকে বললেন, “সা”দের উভয় মেয়েকে দুই তৃতীয়াংশ এবং মাকে অষ্টমাংশ দিয়ে দাও। তারপর অবশিষ্ট যা থাকবে তা হবে তোমার। (জামে তিরমিযী, হাদীস নং-২২২২)
মানব ইতিহাসে নারীর উত্তরাধিকার লাভের এটাই প্রথম নজির। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে ইসলামের এই অসামান্য অভূতপূর্ব অবদানের কথা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এমনিভাবে কোরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দুইয়ের অধিক, তবে তাদের জন্য ওই মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে ব্যাক্তি মারা গেল এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। (সূরা নিসা-১১)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত অংশে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে, অল্প হোক কিংবা বেশি। এই অংশ নির্ধারিত। (সূরা নিসা-৭)
সুতরাং নারীরা কখনো মূল সম্পত্তির অর্ধেক পাবে বা দুই তৃতীয়াংশ পাবে। আবার কখনো এক তৃতীয়াংশ পাবে বা এক চতুর্থাংশ। অথবা অবস্থাভেদে এক ষষ্ঠাংশ পাবে বা এক অষ্টমাংশ। মোটকথা, নারীরা নিকটাত্মীয় ও দূরবর্তী বা কমবেশি হওয়ার ভিত্তিতে তাদের সম্পত্তি বাড়বে কমবে। তবে তারা বাবা-মা স্বামী ও সন্তানের সম্পত্তি থেকে কখনোই বঞ্ছিত হয় না।

নারী শিক্ষার অধিকার:
একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার, সুশীল সমাজ ও আদর্শ জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তো বলা হয় “শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড”। নারী জাতির মুক্তির দিশারী জ্ঞানের আলোকবর্তিকা বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের জন্য নারী পুরুষের মাঝে পার্থক্য করেননি। ইরশাদ করেন, ইলম(ধর্মীয় জ্ঞান) অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান(নারী-পুরুষ) এর উপর ফরজ। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-২২৪)
অনূরূপভাবে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং প্রস্তর। (সূরা তাহরীম-৬)
একথা বলাই বাহুল্য যে, আগুন থেকে বাঁচাতে হলে স্ত্রী সন্তান-সন্ততি নারী-পুরুষ সকলকে ফরজ কর্মসমূহ এবং হালাল ও হারামের বিধানাবলী শিক্ষা দিতে হবে। যুক্তির আলোকেও প্রমাণিত যে, দ্বীনি শিক্ষার মাধ্যমে ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক,সামাজিকতা ও লেনদেন শুদ্ধ হয়। কাজেই নারীদের এসব বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করার বিকল্প নেই। তবে আধুনিক শিক্ষার নামে এবং নারী উন্নয়ন বা নারী মুক্তির স্লোগান দিয়ে পরপুরুষের সাথে একাকার হয়ে পর্দার বিধানকে লংঘন করে সমাজে যা হচ্ছে, তা শরীয়ত সমর্থিত নয়। বরং তা অনর্থক, অপ্রয়োজনীয় এবং নারীদের জন্য অসম্মানজনক। পক্ষান্তরে পর্দার ভিতরে থেকে যদি প্রয়োজন মাফিক হিসাব বিদ্যা ও নারী সংক্রান্ত চিকিৎসা বিদ্যা অথবা কামাই রোজগারের জন্য হস্তশিল্প ও গৃহস্থলীর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিদ্যা শিক্ষা করে, তবে তা দোষণীয় হবে না।

নারীর অর্থনৈতিক ও স্বত্বাধিকার:
ইসলাম নারীকে মালিকানা অধিকার দিয়েছে। নারী জমি-জমা, ধন-সম্পদ, মিল-কারখানা, স্বর্ণ-রূপা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বাড়ি গাড়ির মালিক হতে পারে এবং বৈধ পন্থায় ক্রয় বিক্রয় দান সদকাসহ সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক লেনদেন করতে পারে। বিবাহের সময় স্বামীর পক্ষ থেকে দেনমোহর স্বরূপ অথবা মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার হিসেবে ক্যাশ টাকা বা অন্য কোন স্থাবর অস্থাবর সম্পদ হস্তগত হলে নারী নিজেই এর মালিক হবে।
নবীজির যুগেও দান সদকার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে অনেক নারী নিজেদের অর্থ অলংকার দান সদকা করেছেন বলে একাধিক নজির পাওয়া যায়, যা তাদের অর্থনৈতিক এবং স্বত্বাধিকারের প্রমাণ বহন করে।
এছাড়াও নারীর মানবাধিকার, ধর্মীয় অধিকার, বৈবাহিক অধিকার এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার সহ মানবিক সকল অধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়ে ন্যায্যতা নিশ্চিত করেছেন। কোথাও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেনি। বরং সম্মানজনক ন্যায়সঙ্গত আচরণ করেছেন। এটাই ইসলামের সৌন্দর্যতা ও সার্বজনীনতা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার ও মানার তাওফীক দান করুন। আমীন।


শিক্ষাসচিব, মারকাযুত তারবিয়াহ বাংলাদেশ সাভার, ঢাকা।

শেয়ার করুন
মন্তব্য নেই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।