নারীর সত্যিকারের পথ কোনটি?

কারিমা রিনথী

উসমান বিন আবদুল আলিম
পড়তে লাগবে 6 মিনিট


বর্তমান বিশ্বে ‘নারীর অধিকার’ এক আলোচিত ও তর্কসাপেক্ষ বিষয়। বিশেষত পশ্চিমা নারীবাদ ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই বিষয়ে রয়েছে একটি মৌলিক পার্থক্য— দর্শনে, উদ্দেশ্যে, এবং প্রয়োগে। একদিকে পশ্চিমা নারীবাদ ‘স্বাধীনতা’কে নারীর চূড়ান্ত মুক্তির পথ হিসেবে দেখায়, অন্যদিকে ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকারকে নির্ধারণ করে সৃষ্টি—তত্ত্ব ও দায়িত্ববোধের আলোকে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব, কীভাবে এই দুটি ভাবধারা নারীর অবস্থান ও স্বাধীনতাকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করে এবং কেন ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর প্রকৃত মর্যাদার ধারক ও বাহক।

পশ্চিমা নারীবাদের উৎপত্তি, মূল দর্শন ও উদ্দেশ্য:
পশ্চিমা নারীবাদের মূল ভিত্তি হলো “স্বাধীনতা” এবং “নিজস্বতা”। এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয় মূলত ১৯শ ও ২০শ শতকে। সেই সময় পশ্চিমা সমাজে নারী ছিল পুরুষের ছায়া, ভোটাধিকার ছিল না, শিক্ষার অধিকার ছিল সীমিত, আর কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল বিরল। নারীবাদী আন্দোলন সেই অন্যায় ব্যবস্থা ভাঙার প্রয়াস হিসেবে জন্ম নেয়—যা এক অর্থে ছিল সময়োপযোগী প্রতিবাদ।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলন তার দিক হারাতে শুরু করে। নারীবাদ এখন আর কেবল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক মতবাদ, যা পুরুষবিরোধিতা, পরিবারবিরোধিতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন এক ধারা বহন করে। তারা নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়, বলে—”নারীকে পুরুষের মতো হতে হবে”, কিংবা “নারীর স্বাধীনতা মানেই সকল সামাজিক কাঠামো ও কর্তৃত্ব ভেঙে দেওয়া।” তৃতীয় তরঙ্গে এসে এটি হয়ে দাঁড়ায়—”আমার দেহ, আমার ইচ্ছা”—এমন চেতনার প্রতিচ্ছবি। ফলত, তারা নারীর প্রকৃত পরিচয়কেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়।

ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার:
ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে মানবতার সূচনালগ্নেই। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে…” [সুরা হুজুরাত, (৪৯:১৩)]
ইসলামের দৃষ্টিতে নারী কোনো দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ নয়, বরং পুরুষের সমান মর্যাদার অধিকারী। ইসলামে নারীর প্রথম পরিচয় সে একজন আব্দুল্লাহ—আল্লাহর বান্দা, যার উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত করা এবং ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা। নবি মুহাম্মাদ (সা.) সেই সমাজে নারীকে এমন মর্যাদা দিয়েছেন, যেখানে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি দুই কন্যাসন্তানকে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালনপালন করবে, কিয়ামতের দিন সে এবং আমি একসাথে থাকব—এই দুই আঙুলের মতো (অর্থাৎ খুব কাছাকাছি)।” [সহিহ মুসলিম: ২৬৩১ / সহিহ বুখারি: ৫৯৯৫]
নারীকে ইসলাম দিয়েছে শিক্ষা লাভের অধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, ব্যবসা—বাণিজ্যের সুযোগ, নিজস্ব মতামত পেশের স্বাধীনতা, এমনকি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে অংশগ্রহণের অধিকার।

পরিবার ও মাতৃত্ব:
ইসলাম নারীর সবচেয়ে গৌরবময় পরিচয়কে করে তোলে মা হিসেবে। নবি (সা.) বলেন: “তোমার সদ্ব্যবহারের সবচেয়ে বেশি হকদার‘তোমার মা’ (তিন বার)।”[সহিহ বুখারি: ৫৯৭১ / সহিহ মুসলিম: ২৫৪৮]

অন্যদিকে, পশ্চিমা নারীবাদ পরিবারকে এক “বন্ধন” হিসেবে দেখে। তারা বলে, “মাতৃত্ব মানে আত্মত্যাগ”—যা তাদের কাছে একধরনের ‘বাধা’। তাই পশ্চিমা সমাজে এখন একক মাতৃত্ব, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, গর্ভপাত—এসব “স্বাধীনতা”র নামেই বেড়ে চলছে। অথচ এসবই এক সমাজের ভিত দুর্বল করে দেয়।

পশ্চিমা নারীবাদ বনাম ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি:
পশ্চিমা নারীবাদ যেখানে স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে দেখায়, ইসলাম সেখানে নারীর মর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ দায়িত্বকে সামনে রাখে। পশ্চিমা সমাজে একজন নারীকে “উদার” হতে বলা হয়, যা প্রায়শই তার কাপড়ের দৈর্ঘ্য দিয়ে মাপা হয়। অথচ ইসলাম নারীকে হায়া ও সতীত্বের আড়ালে সম্মানের ঢাল দেয়। আল্লাহ বলেন:
“হে নবি! আপনি আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের উপর চাদরের কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেয়…” [সুরা আহযাব, (৩৩:৫৯)]
পশ্চিমা নারীবাদ নারীর দেহকে বাজারজাত করেছে, তথাকথিত “স্বাধীনতা”র নামে নারীর দেহ হয়ে উঠেছে বিজ্ঞাপনের পণ্য, চলচ্চিত্রের উপকরণ। অথচ ইসলাম নারীর দেহ ও সম্মানকে রক্ষা করে তার হিজাব, পর্দা ও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে।

সমস্যার মূল:
পশ্চিমা নারীবাদ নারীকে মুক্তি দিতে গিয়ে একপ্রকার নতুন দাসত্বে নিক্ষেপ করেছে—সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, মিডিয়ার প্রলোভন, একাকিত্বের বিষণ্ণতা, পারিবারিক ভাঙন এবং যৌনতার পণ্যিকরণ। অথচ ইসলাম নারীকে গৃহে বন্দি করেনি, দিয়েছে মর্যাদা ও রক্ষা।

নবিজি (সা.)—এর ওসিয়ত:
হজ্বের বিদায়ি ভাষণে নবিজি বলেছিলেন:
“তোমরা নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো… তারা তোমাদের স্ত্রী, তাদের অধিকার আছে তোমাদের উপর, যেমন তোমাদেরও আছে তাদের উপর।” (মুসলিম) তিনি নারীদের দিয়েছেন “মা”—এর মর্যাদা, যার পায়ের নিচে জান্নাত। তিনি মেয়ের জন্মকে করুণ নয়, বরং বরকতের নিদর্শন বলেছেন। তিনি নারীর প্রতি ভালোবাসাকে ঈমানের নিদর্শন বলেছেন।

কেন ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিই ভবিষ্যতের আলো?:
পশ্চিমা নারীবাদ নারীকে যত না মর্যাদা দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি দিয়েছে একধরণের বিভ্রান্তি ও দ্বিধা। স্বাধীনতা অর্জনের নামে তারা হারিয়েছে পারিবারিক বন্ধন, নিরাপত্তা ও আত্মসম্মান। ইসলাম নারীকে দেয় ভারসাম্যপূর্ণ পরিচয়—একজন মুমিন, একজন কন্যা, একজন স্ত্রী, একজন মা—যার প্রত্যেক পরিচয়ে রয়েছে মর্যাদা ও দায়িত্ব। ইসলামে নারীকে বলা হয়নি “পুরুষের মতো হও”, বরং বলা হয়েছে, “তুমি নারী, এবং তোমার এই পরিচয়েই রয়েছে তোমার গৌরব।”

পশ্চিমা নারীবাদ ও ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি— এই দুটি পথ দুই বিপরীত গন্তব্যে নিয়ে যায়। একটি নিয়ে যায় আত্মকেন্দি্রক “স্বাধীনতা”র মোহ, আর অন্যটি আল্লাহর বিধানে পরিপূর্ণ “মর্যাদার জীবন”।
আজ মুসলিম নারীর সামনে সবচেয়ে জরুরি দায়িত্ব হচ্ছে: নিজেকে চিনে নেওয়া, ইসলামের চোখে নিজের অবস্থান উপলব্ধি করা এবং আত্মমর্যাদা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে চলা। কুরআন আমাদের সেই পথে আহ্বান জানায়—যেখানে নারী কেবল স্বাধীনই নয়, সম্মানিত। নারী যখন ইসলামের আলোকে নিজের পরিচয় খুঁজে পায়, তখন সে হয় আয়েশার মতো প্রজ্ঞাবান, খাদিজার মতো সফল, ফাতিমার মতো পরিচ্ছন্ন, মারিয়ামের মতো পবিত্র।
এটাই প্রকৃত নারীবাদ—যা আত্মমর্যাদায় ভরা, আল্লাহভীতিতে।

শিক্ষার্থী: সরকারি আদমজীনগর মার্চেন্ট ওয়ার্কার (এম ডবিউ) কলেজ, নারায়ণগঞ্জ।

শেয়ার করুন
উসমান বিন আবদুল আলিম একজন উদীয়মান ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক। তরুণ বয়সেই তিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানার্জন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। কুরআন, হাদীস, ইসলামি দর্শন ও ইতিহাসের ওপর তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং চিন্তাশীল লেখনিতে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইসলামি মূল্যবোধ ও আধুনিক চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি একটি সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করছেন, যা বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে সহায়তা করে। পাশাপাশি, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখালেখি করছেন — যেখানে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, আত্মউন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের বিষয়ে তার বিশ্লেষণ প্রশংসিত হচ্ছে।
মন্তব্য নেই

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।