আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যখন পৃথিবীতে অন্ধকারের ঘনঘটা আর পাপের বিভিষিকা নেমে এসেছিল, পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, ভ্রান্তি আর গোমরাহীর কালো আঁধারে ঢেকে পড়েছিল; ঠিক তখনই মানবতার মুক্তির দিশারী, বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম আদর্শের ঝান্ডা হাতে নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার আগমনে মানবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। সাধিত হলো চূড়ান্ত বিপ্লব। সকল বর্বরতা আর অরাজকতার অবসান ঘটলো। সমাজে ইনসাফ আর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। সর্বত্র রহমতের বারিধারা আর শান্তির সুবাতাস বইতে লাগলো। তাইতো পবিত্র কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৭)
অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উত্তম আদর্শের মূর্ত প্রতীক। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় জীবনেও একমাত্র তার আদর্শই অনুসরণীয় এবং তিনিই উত্তম দিশারী। এজন্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ। (সূরা আহযাব-২১)
অন্যত্র ইরশাদ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেন, তা আঁকড়ে ধরো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর-৭)
উক্ত আয়াতের আহ্বান হলো, জীবনযাত্রার সকল ক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শকেই গ্রহণ করতে হবে।
এই বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো দাম্পত্য জীবন, যা মানুষের জীবনকে সুন্দর সুশৃঙ্খল ও উপভোগ্য করে তোলে। এক্ষেত্রেও সুখ শান্তি আর পূর্ণাঙ্গ সফলতার জন্য নববী আদর্শের বিকল্প নেই।
নবীজির সেই আদর্শ দাম্পত্য জীবন কেমন ছিলো!
আসুন জেনে নিই;
স্ত্রীদের সাথে আচরণ:
স্ত্রীদের সাথে প্রেম-ভালোবাসা আর সুন্দর আচরণ ছিল নবীজির দাম্পত্য জীবনের অন্যতম ভূষণ। উত্তম আচরণে তিনি ছিলেন অনন্য, অসাধারণ। যা ছিল উম্মতের জন্য অনুসরণীয় ও মডেল।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন করো। (সূরা নিসা-১৯)
অনুরূপভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ওহে আমার উম্মত! তোমরা নারীদের সাথে সৎব্যবহার করবে। (সহীহ বুখারী-৫১৮৫)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে সর্বোত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম। (জামে তিরমিযী-৪২৩৩)
আল্লাহ তাআলা আখলাকে নববীর ব্যাপারে ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা আল-কলম-৪)
এজন্য নবীজির দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা)-কে আয়াতে বর্ণিত রাসূলের চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এ কোরআনই হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র। (মুসনাদে আহমদ ৬/১৬৩)
অর্থাৎ কুরআনে যে সকল উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার কথা উল্লেখ রয়েছে সে সবই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন কোরআনী চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক।
স্ত্রীদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা:
স্ত্রীদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আচরণ ছিল সীমাহীন ভালোবাসাপূর্ণ। স্ত্রীদের জীবদ্দশায় যেমন তাদের প্রতি ভালোবাসা সম্মান প্রকাশ করতেন তেমনি তাদের মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি মনের ভালোবাসা ও সম্মান বজায় রেখেছেন।
হযরত খাদিজা রা. সম্পর্কে নবীজি বলেন, আমার অন্তরে তার ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। একই বর্ণনায় আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, যখন ছাগল যবেহ করা হতো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, এখান থেকে খাদিজা রা.-এর সহপাঠীদের (বান্ধবীদের) জন্য পাঠাও। (সহীহ মুসলিম-২৪৩৫)
তার আলোচনা এলেই নবীজি তার প্রশংসা করতেন। তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
তেমনিভাবে আয়েশা রা.-কেও তিনি অত্যন্ত মহব্বত করতেন। তার এ ভালোবাসার কথা তিনি গোপন রাখতেন না।
আমর বিন আস রা. একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলেন, আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? তিনি উত্তর দিলেন, আয়েশা। আমর রা. এরপর জানতে চাইলেন, পুরুষদের মধ্যে কে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আয়েশার বাবা। আমর রা. পূণরায় জিজ্ঞেস করলেন, এরপর কে? উত্তরে নবীজি বললেন, ওমর ইবনে খাত্তাব রা.। (সহিহ বুখারী-৩৬৬২)
তিনি যে একজন অসাধারণ প্রেমময় স্বামী ছিলেন তারই প্রতিচ্ছবি রয়েছে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নামকে আদরাচ্ছলে সংক্ষিপ্ত করে ‘হে আয়েশ’ বলে সম্বোধন করার ভেতরে।
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বলেন, হে আয়েশ! জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এই মাত্র তোমাকে সালাম দিয়ে গেলেন। (মুসলিম শরীফ-২৪৪৭)
স্ত্রীদের অধিকারে সমতা রক্ষা:
হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (স্ত্রীদের মাঝে) বন্টন করতেন এবং (বন্টনে) ইনসাফ করতেন। (সুনানে আবু দাউদ-২১৩৪)
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (সফরের উদ্দেশ্যে) বের হওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন, তখন স্ত্রীদের মাঝে লটারি ধরেছিলেন। (সহীহ বুখারী-৫২১১)
উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে স্ত্রীদের মধ্যকার ইনসাফ ও সমতা রক্ষার বিষয়টি অনুমেয়।
স্ত্রীদের প্রতি ধৈর্য ও সহনশীলতা:
নবীজি স্ত্রীদের সবসময় মমতার চাদরে আগলে রাখতেন। তাদের থেকে প্রাপ্ত অনাকাক্সিক্ষত ও অসংগতিপূর্ণ আচরণগুলোতে তিনি ধৈর্য ধারণ করতেন। তাদের ছোটখাটো ভুলগুলোকেও তিনি এড়িয়ে যেতেন। এ কারনেই দাম্পত্য জীবনের প্রকৃত সুখ যার সবই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারে।
কোনো একবার আবু বকর রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ওই সময় তিনি আয়েশা রা.-কে জোর গলায় রাসূলের সঙ্গে কথা বলতে শুনলেন। অনুমতি পেয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। এরপর তিনি আয়েশা রা.-কে হে উম্মে রুমানের মেয়ে বলে সম্বোধন করলেন। আর তাকে ধরে বললেন, তুমি রাসূলের সঙ্গে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলছ! ঠিক ওই সময় নবীজি বাবা ও মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আবু বকরকে থামালেন। আবু বকর রা. বের হয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রা.-কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বললেন, দেখলে কীভাবে তোমাকে ওই লোকের হাত থেকে বাঁচালাম? এর কিছুক্ষণ পর আবু বকর (রা.) আবারও প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ভেতরে এসে তাদের দুজনকেই হাসতে দেখলেন। (মুসনাদে আহমদ-১৭৯২৭)
নারীদের সঙ্গে সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ও সহনশীল আচরণ বজায় রাখা একজন দায়িত্বশীল স্বামীর পরিচয়। তাদের ওপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করা বা অল্পতেই রেগে যাওয়া ঘৃণিত কাজ হিসেবে বিবেচ্য।
স্ত্রীদের সাথে সময় কাটানো:
স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে সময় কাটানো স্ত্রীদের হক এবং এটি দাম্পত্য জীবনের খুবই উপভোগ্য বিষয়ও বটে।
আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. বলেন, আসরের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের কাছে আসতেন। সবার সঙ্গে দেখা করতেন। এরপর একজনের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতেন। (সহীহ বুখারি-৫২১৬)
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, এমন দিন খুব কমই যেত, যেদিন নবীজি আমাদের সবার কাছে আসতেন না। সব স্ত্রীর সঙ্গে তিনি অন্তরঙ্গ হতেন। তবে সহবাস করতেন না। অতঃপর যার কাছে রাতযাপনের পালা হতো, তিনি সেখানে রাতযাপন করতেন। (সুনানে আবু দাউদ-২১৩৫)
অনুরূপভাবে হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই রাতে সকল স্ত্রীর নিকট যেতেন। (সহীহ বুখারী-৫০৬৮)
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় থাকলেও নবীজি আমার কোলে ঠেস দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। (মুসলিম শরীফ-৩০১)
হযরত মাইমুনা রা. বলেন, আমার ঋতুস্রাবের সময় নবীজি আমার সাথে একই কাপড়ের নিচে ঘুমাতেন। (মুসলিম শরীফ-২৯৫)
স্ত্রীদের সাথে পানাহার:
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি ঋতুস্রাবের অবস্থায় কিছু পান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিতাম। আর তিনি আমার মুখ রাখার স্থানে মুখ রেখে পান করতেন এবং আমি হাড়ের মাংস খেয়ে শেষ করলে তিনি তা গ্রহণ করে আমার মুখ লাগানোর স্থানেই মুখ লাগাতেন। (মুসলিম শরীফ-৩০০)
স্ত্রীদের সাথে রসিকতা ও বিনোদন:
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৈধ পন্থায় রসিকতা ও বিনোদনের মাধ্যমে তাঁর স্ত্রীদের মাঝে আনন্দ ও আন্তরিকতার পরশ জোগাতেন।
হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ভ্রমণে বের হলাম। সে সময় আমি অল্প বয়সী ছিলাম এবং শারীরিক গঠনেও পাতলা ছিলাম। তখনো মোটা তাজা হইনি। তিনি সাহাবীদেরকে বললেন, তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হও। তারা যখন সামনের দিকে অগ্রসর হল, তখন তিনি আমাকে বললেন, এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি। অতঃপর আমি তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলাম এবং আমি তার উপর বিজয় লাভ করলাম। তিনি সে দিন আমাকে কিছুই বললেন না। যখন আমি শারীরিকভাবে মোটা হলাম ও ভারী হলাম এবং তাঁর সাথে কোন এক সফরে বের হলাম। তিনি সাহাবীদের বললেন, তোমরা সামনের দিকে অগ্রসর হও। তারা যখন সামনে অগ্রসর হল। তখন তিনি আমাকে বললেন, এসো আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করি। এবারের প্রতিযোগিতায় তিনি আমার আগে চলে গিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আজকের জয় সেই দিনের প্রতিশোধ। (মুসনাদে আহমদ ৬/২৬৪)
এছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ দাম্পত্য জীবনের আরো অনেক খুঁটিনাটি দিক রয়েছে, যা সীরাতের অধ্যায়ে বিষদ আকারে বর্ণিত হয়েছে। এর থেকে যদি আমরা সামান্য উপকৃত হতে পারি, সেটাই আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি ও সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহ তাআ’লা সীরাতে নববীর আলোকিত পথে আমাদের দাম্পত্য জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক, শিক্ষাসচিব, মারকাযুত তারবিয়াহ বাংলাদেশ সাভার, ঢাকা ।