নবিজির রাজনৈতিক দর্শন: এক মহান রাষ্ট্রনায়কের রূপরেখা

মুফতি উবাইদুল্লাহ তারানগরী

উসমান বিন আবদুল আলিম
পড়তে লাগবে 8 মিনিট

তিনি ছিলেন সময়ের বুক চিরে উঠে আসা এক মহান আলোকবর্তিকা, যাঁর দীপ্তি নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত পৃথিবীর হৃদয়ে। তিনি ছিলেন এক আবেগ, এক অভিপ্রায় ও এক অনন্ত আলো। যাঁর উপস্থিতি সময়ের সীমা ছুঁয়ে যায়। তাঁকে খুঁজতে ইতিহাসের পাতায় হয় না; তিনি আছেন মানুষের হৃদয়ে, বিশ্বাসের ভেতর এবং অশ্রম্নসিক্ত প্রার্থনার গভীরে।

তিনি মুহাম্মদ। তিনি আহমাদ। তিনি আল্লাহর প্রিয় রাসুল সা.। কান্তার মরুতে দাঁড়িয়ে যিনি মানবতার নতুন মানচিত্র এঁকেছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব কেবল আধ্যাত্মিক ছিল না; বরং তা ছিল এক পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক বাস্তবতা, মানবিক রাষ্ট্রদর্শন ও বিশ্বশান্তির সুসংবাদ।
তাঁর মতো নিখুঁত, উদার ও সাহসী কোনো দৃষ্টান্ত এই পৃথিবী কখনো দেখেনি। দেখবেও না। তাঁর রাজনীতি ছিল শিল্পকলা। যেখানে নেতৃত্ব মানে ছিল জবাবদিহি, ক্ষমতা মানে সেবাকাজ, আর প্রশাসন মানে ইনসাফ ও মানবতার ছায়াতল। অসহায়—সহায় সকলের জন্য ছিল শান্তিপূর্ণ আশ্রয়স্থল। প্রকৃতপক্ষে একটি সুন্দর পৃথিবী ও নিরাপদ সমাজ গড়ে ওঠে তার বাসিন্দাদের সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। এই লক্ষ্যেই নবি  এক আলোকোজ্জ্বল, নুরানী, সৎ ও যোগ্য কাফেলার গঠন করেছিলেন, যাঁদের বলা হয় আসহাবে রাসুল বা সাহাবা। তাঁরা এতটাই গুণবান ছিলেন যে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। নবিজি নবুওয়তপ্রাপ্তির পর মক্কি জীবনের ১৩ বছর অক্লান্ত সাধনা করে তাঁদের ইসলামের ছাঁচে গড়ে তুলেছেন। তিনি নিবেদিত ছিলেন ব্যক্তি গঠন ও মানবতা নির্মাণে। আঁধার থেকে আলোর পথে এনে তাঁদের প্রাণবন্ত জীবনের অধিকারী বানিয়েছেন। পরে মাদানি জীবনের ১০ বছরে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন। গড়ে তুলেছেন এক বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র—যা আজও পৃথিবীবাসীর জন্য অনুসরণীয় এক আলোকবর্তিকা। এমনকি অমুসলিমরাও অকপটে তা স্বীকার করেছেন। রাসুলুল্লাহ ও তাঁর সাহাবিদের প্রতি তারা রেখেছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা।
নবিজির রাজনৈতিক দর্শন কেমন ছিল, তার এক সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো;

ঈমান ও ন্যায়ের ছায়ায় রাষ্ট্রগঠন
নবিজির রাষ্ট্র কাঠামো কোনো রাজতান্ত্রিক সিংহাসন বা অহমিকার প্রাচীরে গড়ে ওঠেনি। এর ভিত্তি ছিল ঈমান, আর আলোকচ্ছটা ছিল আল্লাহভীতি। প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল আল্লাহর বিধানে পরিপুষ্ট। তিনি কুরআনের সেই কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন, যেখানে উচ্চারিত হয়— “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় ও সদাচারের আদেশ দেন।” (সুরা আন—নাহল: ৯০)
“তুমি তাদের মাঝে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুযায়ী বিচার কর।” (সুরা আল—মায়িদা: ৪৯)।
তাঁর রাষ্ট্র ছিল ন্যায়ের প্রতীক—যেখানে দুর্বল ছিল নিরাপদ আর শক্তিশালী ছিল জবাবদিহির কাঠগড়ায়।

মদিনার সনদ: বহুজাতিক রাষ্ট্রের সুবাসিত নকশা
মদিনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক ঐতিহাসিক চুক্তি—যা ছিল বহুজাতিক সহাবস্থানের প্রথম লিখিত দলিল। মুসলমান, ইহুদি, মুশরিক—সকলেই ছিলেন রাষ্ট্রের নাগরিক; সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা ছিল নিশ্চিত। এমন সহনশীলতার দৃষ্টান্ত আজকের জাতিসংঘেরও আদর্শ হতে পারে। ১৯৪৮ সালে গঠিত মানবাধিকার কমিশনের সুন্দর ধারাগুলোর চেয়েও অধিক সুন্দর, সর্বোত্তম এবং চিরকাল প্রাসঙ্গিক নীতিমালা নবিজির আলোকোজ্জ্বল রাজনৈতিক দর্শনে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। তাঁর নীতি—আদর্শেই আউস ও খাজরাজ গোত্রের শতবর্ষের দাঙ্গা মুহূর্তে নিভে গিয়ে, তারা পরিণত হয় ভাইয়ে ভাইয়ে।

পরামর্শভিত্তিক শাসন: এক কোমল অথচ দৃঢ় নেতৃত্ব
নবিজি ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি একক কর্তৃত্বের পরিবর্তে শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। যুদ্ধ হোক বা পারিবারিক নীতি, সমাজনীতি বা রাজনীতি—ছোট—বড় সকল বিষয়েই তিনি সাহাবিদের মতামতকে দিতেন বিশেষ গুরুত্ব। কুরআনে আল্লাহ বলেন—
“আপনি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।” (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)।
“যে ব্যক্তি পরামর্শ করে, সে কখনো লাঞ্ছিত হয় না।” (তাবারানি, আউসাত)
এ যেন গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সূচনালগ্ন, যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বরই ছিল রাষ্ট্রচালনার চালিকাশক্তি। কোনো ভয়ভীতি ছিল না, ছিল এক প্রশান্ত সবুজ পরিবেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

ন্যায়বিচার ও সমতার নির্ভীক ঘোষণা
নবিজি ছিলেন বিচারের আসনে অকুতোভয় ও আপসহীন। প্রিয়তম কন্যার বিরুদ্ধেও যদি আইন প্রয়োগের প্রয়োজন হতো, তবুও তা স্থগিত হতো না। সিরাত ও হাদিসের পাতায় তাঁর চির—উজ্জ্বল ঘোষণা, “আমার কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম।” (বোখারি, হাদিস: ৬৭৮৮)।
এই বাক্য শুধু আইনের কঠোরতা নয়; বরং তা ইতিহাসে রাষ্ট্রনায়কসুলভ নৈতিকতার এক অমোঘ বেদী।

শান্তির বার্তা ও কূটনৈতিক দূরদর্শিতা
নবিজি পার্শ্ববর্তী রাজাদের নিকট শান্তির আহ্বান ও ইসলামের দাওয়াত পাঠান। তাঁর কূটনৈতিক ভাষা ছিল মার্জিত, আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। তিনি বলেন— “ইসলাম গ্রহণ করো, নিরাপদ থাকবে।” (বোখারি, হাদিস: ৭৫)।
রোম, পারস্য, আবিসিনিয়ার রাজাদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এই চিঠিগুলো আজও বিশ্ব কূটনীতির জন্য মডেল হতে পারে। এর ভাষা, সৌজন্য ও শান্তির বার্তা এক অনন্য পথনির্দেশিকা।

ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা
মদিনা ছিল এক বাস্তব প্লুরালিস্ট সমাজ, যেখানে অমুসলিমদের উপাসনালয় ছিল নিরাপদ, তাদের অধিকার ছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ছায়াতলে। নবিজি ঘোষণা করেন,
“যে অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম হবে, কিয়ামতে আমি তার বিপক্ষে দাঁড়াব।” (আবু দাউদ: ৩০৫২)
এ শুধু রাজনৈতিক সহনশীলতা নয়; বরং মানবতার শ্রেষ্ঠ ঘোষণা।

যুদ্ধনীতি: নৈতিকতা ও সংযমের অনুপম পাঠ
যুদ্ধ তাঁর কাছে ছিল প্রতিরক্ষা, নিপীড়ন নয়। তাঁর সেনাবাহিনী ছিল নৈতিকতার আদর্শ উদাহরণ, যেখানে বৃদ্ধ, শিশু, নারী ও উপাসনালয়ের বিরুদ্ধে আঘাত ছিল নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, “যারা যুদ্ধ করে না, তাদের ক্ষতি কোরো না।”
“নারী, শিশু, বৃদ্ধ, গাছপালা ও উপাসনালয়ে হাত দিয়ো না।” (আবু দাউদ: ২৬১৪)
“যদি তারা শান্তির প্রতি আগ্রহী হয়, তবে তুমিও শান্তির দিকে ঝুঁকো।” (সুরা আনফাল: ৬১)।

তাঁর যুদ্ধনীতি, কুরআনের নীতিমালায় এবং জীবনাচরণে, আজকের আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের বহু পূর্বেই রচিত হয়েছিল। কথিত শান্তির বিশ্বমোড়লরা যদি তাঁর নীতি থেকে শিক্ষা নিতেন, পৃথিবীর রূপ অন্যরকম হতে পারত।

জনকল্যাণভিত্তিক রাষ্ট্র: মানবতার মা যেমন হওয়া উচিত
নবিজির রাষ্ট্র ছিল একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র—যেখানে বায়তুল মাল ছিল গরিব, এতিম, বিধবা ও অক্ষমদের আশ্রয়স্থল। কুরআনে এসেছে, “তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক আছে।” (সুরা যারিয়াত: ১৯)
এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল শুধু নীতির নয়, বাস্তব দয়ার এক জলছবি।

শ্রমজীবীর মর্যাদা: কর্মের ঘামে গড়া সম্মান
নবিজি বলেন, “তোমাদের অধীনস্থদেরকে তোমরা নিজের ভাই মনে করো।” (বোখারি: ৩০)।
“শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো।” (ইবনে মাজাহ: ২৪৪৩)।
এই বাণী শুধু স্লোগান নয়, বরং সমাজ প্রতিষ্ঠার এক বাস্তব অঙ্গীকার। শ্রমিকের ঘামে গড়া সম্মান, এটাই ছিল তাঁর সমাজদর্শনের বৈশিষ্ট্য।

ইনসাফের আলোয় উদ্ভাসিত বিচারব্যবস্থা
“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হও।” (সুরা নিসা: ১৩৫)।
এই কুরআনি আহ্বান বাস্তবায়িত হয়েছিল নবিজির হাতে, এমন এক বিচারে, যেখানে আত্মীয়তা, ধনসম্পদ বা প্রভাব কোনো কাজে আসত না।

নেতৃত্ব মানে জবাবদিহিতা:
নবিজি বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, এবং তার দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।” (সহিহ বুখারি: ৮৯৩)।
এই এক বাক্যেই তিনি নেতৃত্বের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন। নেতৃত্ব ছিল না সিংহাসন—বরং আমানতের এক ভার।

নারীর সম্মান ও অধিকারের ঘোষণা:
যেখানে নারীদের ছিল না কোনো সামাজিক অবস্থান কিংবা সম্মান, সেখানে তিনি তাঁদের দিয়েছেন সম্পত্তির অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। তিনি বলেন—“নারীরা পুরুষদের সহচর, তারা তাদের মতোই সম্মানিত।” (আবু দাউদ: ২১৩৪)।
“আমি তোমাদের কাছ থেকে নারীদের ব্যাপারে সদাচরণ নেবার অঙ্গীকার নিই।” (মুসলিম)।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও চুক্তির নৈতিকতা:
হুদাইবিয়ার চুক্তি ছিল নবিজির দূরদর্শী কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচায়ক, যা রক্তপাত থামিয়ে মানবতাকে বিজয়ী করেছে। এ চুক্তি যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে। বাহ্যত অনুকূল মনে না হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ছিল কল্যাণকর। আল্লাহ বলেন, “তোমরা যা অপছন্দ কর, তাতেই আল্লাহ অনেক কল্যাণ রাখেন।” (সুরা নিসা: ১৯)।

ধর্ম ও রাষ্ট্রের একীভূত রূপ
নবিজির রাষ্ট্রে ধর্ম ও প্রশাসন ছিল একই বৃত্তে দুটি কুসুম। কুরআন ছিল সংবিধান, আর তাঁর চরিত্র ছিল সেই সংবিধানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর আলোকপ্রবাহে ইয়ামান থেকে হাজারামাউত পর্যন্ত এমন শান্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যেখানে একজন তরুণীও নির্ভয়ে চলাফেরা করত, কেউ চোখ তুলে তাকাত না।

নবি মুহাম্মদ (সা.)—এর রাজনৈতিক দর্শন শুধু এক দক্ষ শাসকের পরিচয় নয়—এটি এক দীপ্ত নৈতিক সংবিধান, মানবিক নেতৃত্বের আদর্শ ও আল্লাহভীতির ছায়াতলে গড়ে ওঠা এক চিরন্তন সমাজচিত্র। এ দর্শন শুধু মুসলিমদের নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যও প্রাসঙ্গিক। এখানে শাসন মানে সেবা, আইন মানে ইনসাফ আর রাষ্ট্র মানে শান্তির ঘর। যে আদর্শে থবী বদলে যেতে পারে জান্নাততুল্য শান্তিময় আবাসে।

মুহাদ্দিস, জামিয়া ইবনে আব্বাস (রা.) সামান্তপুর, জয়দেবপুর, গাজীপুর সিটি।

শেয়ার করুন
উসমান বিন আবদুল আলিম একজন উদীয়মান ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক। তরুণ বয়সেই তিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানার্জন ও গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। কুরআন, হাদীস, ইসলামি দর্শন ও ইতিহাসের ওপর তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং চিন্তাশীল লেখনিতে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইসলামি মূল্যবোধ ও আধুনিক চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি একটি সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করছেন, যা বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য বুঝতে সহায়তা করে। পাশাপাশি, তিনি নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে লেখালেখি করছেন — যেখানে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, আত্মউন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের বিষয়ে তার বিশ্লেষণ প্রশংসিত হচ্ছে।
একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।